বিমানের দামে একটি দেশের বাজেট ! কী এমন আছে বি-টু স্পিরিটের ভেতর?

স্টাফ রিপোর্টার
0

 


আন্তর্জাতিক ডেস্ক, দৈনিক সারা দুনিয়া।


নিশব্দ ‘ভয়ংকরী’: যুদ্ধের ময়দানে হিসাব-নিকাশ বদলে দেওয়া এক বিমানের গল্প

বিশ্ব রাজনীতির উত্তপ্ত মানচিত্রে হঠাৎ করেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এক রহস্যময় যুদ্ধযান—বি-টু স্পিরিট স্টিলথ বোম্বার। এই বিমান কোনো সাধারণ যুদ্ধবিমান নয়; বরং এক মহাকাব্যের চরিত্র, যার অস্তিত্বই বদলে দিতে পারে যেকোনো যুদ্ধের গতিপথ। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এই আকাশযান যেন এক ভাসমান অদৃশ্য হাতিয়ার—শত্রুর আকাশসীমা পেরিয়ে হামলা চালায় নিঃশব্দে, নিখুঁতভাবে, ভয়ংকর নির্ভুলতায়।

গতকাল মধ্যরাতে ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ অভিযানে যখন ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র, তখন থেকেই নতুন করে আলোচনায় এসেছে বি-টু বোমারু। ৩৭ ঘণ্টার অবিরাম উড্ডয়নে ইরানের বুকে ছয়টি ভয়ংকর ‘বাঙ্কার বাস্টার’ ফেলা হয়েছে এই বিমানের পেট থেকে। খবর ছড়িয়ে পড়তেই আবারও উঠে এসেছে প্রশ্ন—কী এমন আছে বি-টু স্পিরিটের ভেতর, যা একে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর বোমারুতে পরিণত করেছে?

একটি বিমানের দামে একটি দেশের বাজেট!

প্রতিটি বি-টু স্পিরিটের দাম প্রায় ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যায়! একেকটি বিমানের মূল্য দিয়ে একটি উন্নয়নশীল দেশের বার্ষিক বাজেটের অর্ধেক মেটানো সম্ভব। এ পর্যন্ত মাত্র ২১টি বি-টু তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি অবসরে গেছে, দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়েছে আরও কয়েকটি। বর্তমানে ১৯টি বি-টু রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইটম্যান বিমানঘাঁটিতে, যেখানে ২৪ ঘণ্টা বিশেষ সুরক্ষায় রাখা হয় এদের।

ডিজাইনে বাজপাখির ছায়া

বি-টু স্পিরিট দেখতে অনেকটা ত্রিকোণাকার বা উড়ন্ত ডানার মতো। এর নকশা তৈরি হয়েছে প্রকৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে—বাজপাখির উড্ডয়নের মতোই। বাইরে বিশেষ রাডার-শোষণকারী প্রলেপ; যার ফলে শত্রুপক্ষের শক্তিশালী রাডারও বি-টু’কে শনাক্ত করতে পারে না। বিশালাকৃতির এই বিমানটি শত্রুর স্ক্রিনে মাত্র একটি ছোট পাখির সমান সংকেত দেয়। এই ‘স্টিলথ’ প্রযুক্তিই বি-টু কে পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় ও ভয়ংকর আকাশযানে পরিণত করেছে।

আকাশের নিরব ঘাতক

বি-টু বোমারু শুধু উড়তে পারে না, উড়ে যেতে পারে বিশ্বের যেকোনো কোণে—নিরব, অদৃশ্য, শনাক্তের বাইরে। টানা ১১ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে উড়তে পারে, আবার আকাশেই জ্বালানি নিতে পারে। এই বিমানের বুকে থাকে ১৮ টন বিস্ফোরক; পারমাণবিক বোমা, জিপিএস গাইডেড স্মার্ট বোমা, মাটির গভীরে ঢুকে পড়া ‘বাঙ্কার বাস্টার’—সবই বহন করতে পারে। ১৩ হাজার ৬০০ কেজি ওজনের GBU-57 বাঙ্কার বাস্টার দিয়ে ৬০ মিটার গভীর বাঙ্কারও গুঁড়িয়ে দিতে পারে। ইরানের বুকে ফেলা হয়েছে এই ভয়ংকর অস্ত্রই।

কারিগরি কীর্তি ও কূটনৈতিক সংকেত

বি-টু বোমারু কেবল যুদ্ধের হাতিয়ার নয়, এক কঠিন কূটনৈতিক বার্তাবাহকও। যখন এই বিমান আকাশে ওঠে, গোটা বিশ্ব বুঝে—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো কূটনৈতিক ধোঁয়াশা রাখছে না। সরাসরি বার্তা দেওয়া হচ্ছে—“আমরা প্রস্তুত, যেকোনো মূল্যে।”

গোপনতার চাদরে মোড়া

বি-টু প্রকল্প এতটাই গোপন ছিল যে, একসময় মার্কিন কংগ্রেসেরও প্রকৃত খরচ জানা ছিল না। আজও এটির প্রযুক্তির বেশির ভাগই অজানা বিশ্ববাসীর কাছে। এর উপাদান, রং, তাপমাত্রা-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সবই রহস্যে মোড়া। তাই এটিকে কেবল যুদ্ধবিমান বলা যায় না, বরং এটি এক ভাসমান দুর্ভেদ্য অস্ত্রভাণ্ডার—যার ছায়া দেখলেই কাঁপতে থাকে প্রতিপক্ষ।

ইরানের বার্তা: কতটা সফল এই হামলা?

ইরান দাবি করেছে, তারা আগেই পারমাণবিক স্থাপনাগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলেছে। তবে এই হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক সক্ষমতার প্রদর্শনী করল বিশ্বের সামনে। এটা ছিল শুধু প্রযুক্তির খেলা নয়, ছিল বিশ্বশক্তিকে চুপিসারে কানে কানে বলে যাওয়া এক হুঁশিয়ারি—“বি-টু আকাশে, সাবধান”।

বি-টু স্পিরিট তাই কেবল বিমানের নাম নয়। এটি এক ভাসমান আতঙ্ক, এক চলমান বার্তা—যা যুদ্ধের ভাষা বদলে দেয়। এবং বিশ্বের যেকোনো শত্রু জানে—যদি বি-টু একবার চোখের আড়ালে চলে যায়, তার আর খোঁজ পাওয়া মুশকিল।

বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে দামি, সবচেয়ে নিরব আর সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধবিমানটির গল্প এখানেই শেষ নয়—এর ছায়া হয়তো আবারও দেখা যাবে আরও কোনো উত্তপ্ত আকাশে, কোনো নতুন যুদ্ধের প্রাক্কালে। তথ্যসূত্র: আলজাজিরা, পেন্টাগন ব্রিফিং, বিবিসি, রয়টার্স


Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)